শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:০৯ অপরাহ্ন
একজন মানুষের এত রূপ, এত পরিচয়—যেন পুরো সমাজ ব্যবস্থার ফাঁকফোকর গলিয়ে উঠে আসা এক ভয়ংকর ছায়া। গাজীপুর মহানগরে সম্প্রতি এক ব্যক্তির নানা মুখোশ উন্মোচনের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ ও আতঙ্ক।
এই বহুরূপী ব্যক্তির নাম আনোয়ার হোসেন সৌরভ (৩১)। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার মুকশোপুড় গ্রামের বাসিন্দা সৌরভ বর্তমানে গাজীপুর শহরের সাহাপাড়া এলাকায় অবস্থান করছেন। তাকে ঘিরে যেসব তথ্য সামনে এসেছে, তা রীতিমতো রোমহর্ষক।
সাংবাদিক না ছদ্মবেশী অপারেটর-
জানা যায়, আনোয়ার হোসেন নিজেকে একজন “সাংবাদিক” হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তার কাছে রয়েছে ঢাকাভিত্তিক একটি কম প্রচারিত পত্রিকার আইডি কার্ড। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পত্রিকাটির সঙ্গে তার কার্যকর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আইডি কার্ডটি শুধুমাত্র ভেক দেখানোর হাতিয়ার।
এই পরিচয়ের আড়ালে তিনি কখনো পুলিশের কর্মকর্তা, কখনো কোর্টের সহকারী, আবার কখনো সামাজিক কর্মী—এমন নানা পরিচয়ে নিজেকে উপস্থাপন করে সাধারণ মানুষ ও প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন।
সূত্র থেকে শুরু, প্রতারণায় পরিণতি-
২০১৮ সালে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের টঙ্গী পশ্চিম থানায় তিনি পুলিশের অঘোষিত “সোর্স” বা তথ্যদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেসময়ই পুলিশের বিভিন্ন কৌশল, মামলা লেখার পদ্ধতি ও ভিতরের লেনদেন সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ ধারণা লাভ করেন। এই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে ধীরে ধীরে নিজের একচ্ছত্র প্রভাব গড়ে তোলেন।
একাধিক স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সেই সময়েই তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন। এর পরেও পুলিশের আশপাশে ঘোরাঘুরি বন্ধ হয়নি বরং আরও গভীরে জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন বেআইনি কাজে।
ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলা-
সৌরভের মূল অস্ত্র—ভয়ভীতি। কখনো নিজেকে পুলিশের এসআই পরিচয়ে তুলে ধরেন, আবার কখনো ভুয়া নিউজ প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারী বা সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করেন। কেউ টাকা দিতে না চাইলে তার নামে গুজব ছড়িয়ে দিয়ে অনলাইনে মিথ্যা খবর ছাপিয়ে দেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি নিবন্ধনবিহীন একাধিক অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে “সংবাদ” প্রকাশ করেন, যেগুলোর কোনো সাংবাদিক মানদণ্ড নেই। এরপর সেই স্ক্রিনশট নিয়ে ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে চালান অপপ্রচার।
এই কৌশলে কেবল সাধারণ মানুষ নয়, অনেক সাংবাদিক, পুলিশ সদস্য, এমনকি সরকারি কর্মকর্তা পর্যন্ত তার প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
ভুয়া প্রেস ক্লাবের ছত্রছায়ায় অপকর্ম-
বর্তমানে সৌরভ “সেন্ট্রাল প্রেসক্লাব, গাজীপুর” নামের একটি বিতর্কিত সংগঠনের সদস্য। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই ক্লাবটির সভাপতিও একজন জেল খাটা দাগি আসামি, যার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এই প্রেস ক্লাবের ব্যানার ব্যবহার করে সৌরভ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে তাদের সামাজিকভাবে হেয় করে তুলছেন।
এমনকি গাজীপুর মেট্রোপলিটনের অন্তত আটটি থানার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও একাধিকবার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।
আইনের চোখে অদৃশ্য – কেন?
সৌরভের বিরুদ্ধে এতসব তথ্য থাকার পরেও কেন তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না—এ প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের মনে। কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের ভিতরের কিছু দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে চলছেন তিনি। আবার কেউ বলছেন, প্রশাসনের কিছু অসাধু সদস্য তাকে ‘অফ দ্য রেকর্ড’ সুবিধা দিয়ে থাকেন।
যাই হোক, সচেতন নাগরিকদের একটাই দাবি—এই ধরনের ছদ্মবেশী, ভুয়া পরিচয় ব্যবহারকারী প্রতারকের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, না হলে ভবিষ্যতে এর ফলাফল হবে ভয়াবহ।
উপসংহার: একা সৌরভ নয়, সিস্টেমই প্রশ্নের মুখে-
সৌরভের মতো ব্যক্তি কেবল একজন অপরাধী নয়, সে একটি অসুস্থ ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। প্রশাসনিক তদারকি, সাংবাদিকতা পেশার শুদ্ধতা এবং অনলাইন মিডিয়ার নীতিমালা—সবকিছুতেই এখন দরকার কঠোর শুদ্ধি অভিযান। নইলে সৌরভরা থেমে থাকবে না, বরং নতুন রূপে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ফিরবে।
[এ নিয়ে থাকছে আমাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদকের ধারাবাহিক পর্ব। অচিরেই আসছে ২য় পর্ব। দেখতে চোখ রাখুন মিডিয়া বাজ পত্রিকায়]