বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৩২ পূর্বাহ্ন
গ্রাহকের টাকা নিয়ে হয়রানি না করার জোর দাবি গ্রাহক ও কর্মকর্তারা ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড।
ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স অনিয়ম, গ্রাহক ভোগান্তি বেড়েই চলছে। ম্যাচিউর হওয়া পলিসির টাকা দিতে গ্রাহক হয়রানি, নির্দিষ্ট সময় পার হলেও প্রিমিয়ামের টাকা পরিশোধে বিলম্ব, হিসাবে অনিয়মসহ নানা অব্যবস্থাপনায় চলছে ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ । এমন নাজুক পরিস্থিতি ভাবিয়ে তুলছে বীমা গ্রাহক ও বীমা খাত সংশ্লিষ্টদের। ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছে পাওনা টাকার জন্য ভিড় করছেন গ্রাহকরা। বীমা কোম্পানির হয়রানির বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বরাবর অভিযোগের জন্য সেল থাকলেও বেশির ভাগ গ্রাহকই তা জানেন না। ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড, বিরুদ্ধে গ্রাহকদের টাকা পেতে ভোগান্তির কথা জানিয়েছে গ্রাহক ও বিভিন্ন অঞ্চলের জোনাল ইনচার্জরা। বীমা কোম্পানিগুলো মালিকপক্ষের লুটপাটের কারণে সংকট তৈরি হয়েছে এই খাতে।
সূত্র জানায়, ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের কাছে বার বার গ্রাহকদের ৩ থেকে ৪ বছর আগে ম্যাচিউর হওয়া পলিসির টাকা পরিশোধে তাগাদা দিয়ে আসলেও তারা জোনাল ইনচার্জদের পাঠানো এসব অনুরোধ আমলে নিচ্ছে না। ফলে জোনাল অফিসে গ্রাহকরা এসে নানা হুমকি-ধামকি, অফিসে ভাঙচুর চালাচ্ছে। যার কারণে অনেকে হয়েছেন বাড়িছাড়া। হেড অফিসে এগুলো জানালে তারা ইনচার্জদের ডেকে নিয়ে মিটিং করে সম্পত্তি বিক্রি করা হলে তখন টাকা দেয়া হবে বলে আশ্বাস দিচ্ছেন। যেটা কার্যত তারা আদৌও করছেন না। করোনার সময় থেকে নানা অজুহাতে টাকা দিতে বিলম্ব ও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে ফারইষ্টের গ্রাহকদের। এদিকে,
সূত্র জানায়, ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের টাকা বিগত সময়ে যে পরিচালনা পর্ষদ ছিল তারা টাকা লুটপাট করে পালিয়েছে। জমির নির্দিষ্ট মূল্যের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত দামে কেনারও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। নির্দিষ্ট কিছু এলাকা ছাড়া সারা দেশের গ্রাহক টাকা পেতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। সম্পদ বিক্রির অজুহাতে মিথ্যা আশ্বাসে গ্রাহক ও জোনাল অফিসারদের ঘোরানো হচ্ছে। এ ছাড়াও ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সিও তার নিজস্ব এলাকায় পলিসির টাকা পরিশোধে গুরুত্ব দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বীমা আইন ২০১০ অনুযায়ী, গ্রাহক কোম্পানিতে বীমা দাবির জন্য আবেদন করার ৯০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হয়। কিন্তু মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও কিছু কোম্পানি দাবি পরিশোধ করছে না।
সরজমিনে বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করে দেখলাম এলাকায় গড়ে ওঠা এসব কোম্পানি অফিসে অফিসে গ্রাহকদের ভিড়। ২ ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা মিলে সেখানে গ্রাহকরা তাদের জমানো প্রিমিয়ামের টাকা নিতে এসে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তাদের এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে পাঠানো হচ্ছে। কর্মকর্তারা কেউই এই বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন না। ফারইষ্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অধীনে একক বীমা সর্বজনী বীমা প্রকল্পের গ্রাহকরা টাকা তুলতে এসেছেন বেশি। তাদেরকে ফান্ড নেই বলে ঘুরানো হচ্ছে এমন চিত্রও দেখা যায়।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান কার্যালয়ে অবস্থান করে দেখা যায় গ্রাহক ভোগান্তির চিত্র।
একাধিক গ্রাহক বলেন, আমাদের ম্যাচিউর হওয়া পলিসির টাকা দিতে তারা এভাবে ঘুরাচ্ছে আমাদের। নিরুপায় হয়ে গেছি আমরা। মানুষ বিপদ-আপদের জন্য বীমা করে। দরকারের সময় যদি টাকা নাই পাই এভাবে ভোগান্তি পোহাতে হয় তাহলে কেন মানুষ বীমা করবে? বীমার ওপর ভরসাই করবে কীভাবে বলে অভিযোগ করেন তারা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাকা না পাওয়াটা বীমা খাতের বড় ভীতি। কিছু কিছু কোম্পানি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। মানুষের টাকা লুট করে অনেক কোম্পানির মালিক আখের গুছিয়েছেন। বর্তমান সময়ে অনেক কোম্পানির মালিক কিংবা ব্যবস্থাপকদের চুরি করে অফিস করতে হচ্ছে। অনেকে নিজেদের অফিসে নিজেরাই প্রকাশ্যে আসতেছেন না। এসব সমস্যা থেকে বীমা খাতকে বাঁচাতে বড় ধরনের সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। এত কিছুর পরও নীরব নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। আইডিআরএ’র কার্যক্রম নিয়ে রয়েছে নানামুখী অভিযোগ। বিশাল পরিমাণের বীমা দাবি নিষ্পত্তি না করার বিষয়ে খাত সংশ্লিষ্টরা অপরিকল্পিত ও মন্দ বিনিয়োগকে দায়ী করছেন। তাছাড়া এজেন্টদের উচ্চহারের কমিশন দেয়া ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও দায়ী বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, সময়মতো বীমা দাবি পরিশোধ না হওয়াতে সামগ্রিকভাবে বীমা খাতের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। এ কারণে জীবন বীমা গ্রাহণের হার বাড়ার বদলে কমছে।
ম্যাচিউর পলিসি পরিশোধে বিলম্ব: ম্যাচিউর হওয়া পলিসির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৩ থেকে ৪ বছর পার হলেও গ্রাহকদের টাকা দেয়া হচ্ছে না। নানা বাহানায় ঘুরানো হচ্ছে গ্রাহকদের। আবার ২ থেকে ৩ বছর ঘুরে কেউ টাকা পেলেও চুক্তি ও ঘোষণামতো টাকা পাচ্ছেন না। নামমাত্র চেক ধরিয়ে দিয়ে দায়সারা হচ্ছে বলেও অভিযোগ বীমা গ্রাহকদের। চেক পেতেও দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। অনেককে বাধ্য করা হচ্ছে পুনরায় বীমা পলিসি করতে। বার বার সময় দিয়ে অফিসে আসলে সম্পত্তি বিক্রি করা হয়নি দাম কম এমন কথা বলে গ্রাহকদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
চেক বিড়ম্বনা: গ্রাহকদের চাপের মুখে বীমা কোম্পানিগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ পলিসির বিপরীতে ৩ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত তারিখ দিয়ে ব্যাংক চেক প্রদান করলেও কার্যত চেক ডিজঅনার হয় (কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকলে ব্যাংক তা প্রত্যাখ্যান করে দেয়)। এ অবস্থায় বার বার চেকের তারিখ পরিবর্তন করেও টাকা দিতে ব্যর্থ হয়েছে অনেক কোম্পানি। এই পরিস্থিতির কারণে গ্রাহকরা এখন ব্যাংক চেক প্রদান থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। চেক দেয়ার নামে গ্রাহকদের শান্ত রাখার একটা অপকৌশল এটা। ব্যাংকে পর্যাপ্ত টাকা থাকুক না থাকুক। অনেক কোম্পানি একের পর এক চেক ইস্যু করে যাচ্ছে।
প্রতারণার অপকৌশল: টাকা বা বীমা দাবি পরিশোধের বদলে গ্রাহকদের পুনরায় পলিসি করার চাপ সৃষ্টি করা বা বাধ্যতামূলক পুনরায় পলিসি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ ছাড়াও এফডিআর নামক ভোগান্তিতে জড়ানোর পাঁয়তারা করছে অধিকাংশ কোম্পানি। এতে বেশির ভাগ জোনাল অফিসার ইনচার্জরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। গ্রাহকদেরও ভোগান্তি বেড়েই চলছে।
অনেকে আবার বীমা দাবির অর্ধেক টাকা পরিশোধ এবং অবশিষ্ট টাকা দিয়ে পুনরায় বীমা পলিসি করতে বাধ্য করে থাকে। এতে নিজের টাকা না পেয়ে বরং প্রতারণার শিকার হচ্ছেন গ্রাহকরা। এসব কারণে বেশির ভাগ পলিসি অচল হয়ে পড়েছে। যা বীমা খাতের জন্য ক্যান্সার স্বরূপ।